অন্তহীন- পর্ব ৭
শুভাশিস সাহা
পর্ব- সাত
জীবনটা টি-টোয়েণ্টি ম্যাচ নয়। এক দীর্ঘ মেয়াদি টেস্ট ম্যাচ। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস সমস্ত বাউন্সার সামলে ক্রিজে টিকে থাকাই জীবন। মফস্বলের এক তরুণ নন্তুর জীবনের সেই বাউন্সার সামলানোর গল্প এবার। কর্মস্থলে অন্যায় বহিষ্কার থেকে হকের টাকা না পাওয়া। পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে অন্য শহরে পাড়ি দেওয়া , চোখের সামনে মৃত্যুকে দেখা। সব বাউন্সার সামলে নন্তু কি পারবে জীবনের ম্যাচে টিকে থাকতে? নাকি হেরে যাবে হতাশার চোরাবালিতে? নন্তুর জীবনের অন্তহীন লড়াই নিয়ে ধারাবাহিক উপন্যাস ‘অন্তহীন’। লিখছেন শুভাশীষ সাহা। এই লেখায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ঘটনা, স্থান, কাল ও পাত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক এর সঙ্গে বাস্তবের কোনও মিল থাকলে তা সম্পূর্ণই কাকতালীয়।
১৯
শ্রীময়ির বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে গেল। কলিং বেল বাজাতেই বাবা দরজা খুললেন। বাবাকে দেখে অবাক হল শ্রীময়ি। “আরে তুমি কখন এলে?” বলেই বাবাকে জড়িয়ে ধরল।
“এই তো সন্ধ্যেবেলা ফিরলাম”
দরজা বন্ধ করতে করতে শ্রীময়ি বলল, “তোমার তো কাল ফ্লাইট ছিল?”
বাবা হাসলেন, “ইচ্ছে করে তোকে মিথ্যে বলেছিলাম, বললে কি আর এই খুশিটা দেখতে পেতাম আমার রাজকুমারীর!”
শ্রীময়ি সোফায় বসে বলল, “তোমার রাজকুমারী আজ এমনিতেই খুব খুশি”
“বাহ তাই নাকি? আজ গেছিলি কোথায় তুই এরকম সেজেগুজে?”
শ্রীময়ি বলল, “কোথায় সাজলাম? শুধু শাড়িই তো পরেছি!”
“আজ কি স্পেশাল কিছু ছিল? বিজয়া সম্মেলন চলছে নাকি এখনও?”
“স্পেশাল তো ছিলই, তবে বিজয়া সম্মেলন নয়, একজনের –”
“হ্যাঁ রে নন্তুর সাথে দেখা হয়েছে? ও কবে যাচ্ছে?” মা বেডরুম থেকে বেরিয়ে হলঘরে শ্রীময়িকে দেখেই জিজ্ঞেস করলেন।
মায়ের কথা শুনে বাবা বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা। মুচকি হেসে বাবা বললেন, “ওহ তাহলে এই হচ্ছে স্পেশাল ব্যাপার!”
বাবার খোঁচায় লজ্জা পেল শ্রীময়ি, “হ্যাঁ মানে ওই আর কি, নন্তু বম্বে চলে যাচ্ছে পরশুদিন, তাই আজ দেখা করতে গেছিলাম”
“বম্বে যাচ্ছে কেন? কাজের ব্যাপারে?”
মা এসে শ্রীময়ির পাশে বসে বললেন, “হ্যাঁ, ও নিউজ ইন্ডিয়া থেকে একটা চাকরির অফার পেয়েছে”
বাবা চোখ বড় করে বললেন, “বল কি গো? দারুণ খবর তো!”
শ্রীময়ি বলল, “নিউজ ইন্ডিয়ার বাংলা চ্যানেল আসছে সামনে, বাংলা টিমে জয়েন করছে নন্তু”
“বাহ, শুনে সত্যিই ভালো লাগল”
শ্রীময়ি মায়ের কোলে মাথা রেখে বলল, “আমি বলেছিলাম না তোমাদের, দেখবে ও একদিন বড় কিছু করবে, এই তো সবে শুরু”
শ্রীময়ি মায়ের কোলে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। মা শ্রীময়ির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “আমরা কি তাহলে ওর বাবা মায়ের সাথে গিয়ে কথা বলি এবার?” বলেই চোখ টিপলেন বাবার দিকে তাকিয়ে।
কোল থেকে মাথা না তুলেই শ্রীময়ি বলল, “ধুর, দাঁড়াও না। এত তাড়া কিসের তোমাদের?”
বাবা মুচকি হেসে বললেন, “হ্যাঁ, শুভ কাজে দেরী করে লাভ কী?”
শ্রীময়ি এবার উঠে বসল, “দাবিটা কী তোমাদের শুনি? এত তাড়া কিসের? ছেলেটা একটা নতুন শহরে যাচ্ছে, নতুন কাজ, নতুন জায়গা আগে সেটল তো করতে দাও!”
বাবা বললেন, “আহ তুই রাগ করছিস কেন? আমি আর তোর মা তো মজা করছি তোর সাথে…”
শ্রীময়ি মায়ের দিকে তাকাল, মা হাসছে।
“ওহ তাহলে আমার পেছনে লাগা হচ্ছিল!”
বাবা মা দুজনেই হেসে উঠলেন। শ্রীময়ি আবার মায়ের কোলে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল।
“হাসো হাসো, আমিও ভাবছি পিএইচডি’র জন্য বাইরে কোথাও অ্যাপ্লাই করব। দেখব তখন কি করে পেছনে লাগো আমার!”
শ্রীময়ির মাথায় হাত দিয়ে আদর করতে করতে মা বললেন, “কোথায় যাওয়ার প্ল্যান ঘুরছে মাথায় শুনি?”
“জানিনা, ঠিক করিনি কিছু”
বাবা বললেন, “বম্বে আইআইটির আর্থ সায়েন্স ডিপার্টমেন্টটা ভালো শুনেছি…”
শুনে শ্রীময়ি অবাক হয়ে মুখ তুলল, “বাবা তুমি কি করে পার বল তো? বারবার আমার মনের কথাটা বুঝে যাও কিভাবে?”
“আমি তো আমার মাকে চিনি রে, তুই যে মনে মনে এটা ভাবতে পারিস সেটার কি আমি বুঝিনা ভেবেছিস?”
“আমার প্ল্যানটাই সেটা ছিল, বম্বে আইআইটিতে চান্স পেয়ে সোজা বম্বে গিয়ে নন্তুকে সারপ্রাইজ দেব”
মা বললেন, “তুই পারবি নন্তুর থেকে লুকাতে?”
“বিয়ে ক্যান্সেল করার ব্যাপারটাও তো বলিনি এখনও নন্তুকে, সেটা অবশ্য বলেই দিতাম আর কদিন পরে, কিন্তু এখন ঠিক করলাম একেবারে বম্বে গিয়েই টোটাল সারপ্রাইজটা দেব, কী মা প্ল্যানটা কেমন?”
মা শুনে উঠে পড়লেন, “বুঝিনা বাপু, তোদের কাজ কারবার। এখন খাবি চল, বাসন্তীর রুটি করা হয়ে গেছে”, বলেই ডাইনিং-এর দিকে চলে গেলেন।
বাবা বললেন, “প্ল্যানটা কারেক্ট আছে, আইআইটি-র জন্য প্রস্তুতি নে ভালো করে, আর জলদি ফ্রেশ হয়ে আয়, খেতে বসব একসাথে”।
২০
ছেলে বম্বে যাওয়ার খুশিতে আরতীদেবী মহা ধুমধাম করে কালিপুজোর আয়োজন করেছেন। কালিপুজোতে সব আত্মীয়দের নিমন্ত্রণ করেছেন। পাড়া প্রতিবেশীদের কাউকে বাকি রাখেননি নিমন্ত্রণ করতে। বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের কেউ বম্বে যাওয়া মানে মিঠুন চক্রবর্তী হয়ে যাওয়া। নন্তুর আত্মীয়রাও নন্তুকে মিঠুন চক্রবর্তী ভেবে ফেলেছে। কালিপুজোর রাতে বহুদিনের না দেখা হওয়া দূর সম্পর্কের জেঠিমা থেকে পাশের পাড়ার রুমকি কাকিমা, বাবার মাসতুতো দাদা থেকে বাজারের সুখেন কাকু – সবাই নন্তুকে দেখলেই “কি দারুণ খবর”, “কত ভালো চাকরি” জাতীয় কথায় ভরিয়ে দিয়েছে। নন্তুর নিজেকে কেমন যেন একটা সেলিব্রিটি মনে হচ্ছিল সেদিন। একটু বয়স্ক মানুষেরা তো আরেক ধাপ উঠে নন্তুর মাকে বলেছেন, “এত ভালো চাকরি পেয়েছে যখন এবার বড় ছেলের বিয়ে দাও আরতী”। কথাগুলো নন্তুও শুনেছে, মুচকি হেসে এড়িয়ে গেছে। নন্তুর একটা ভালো খবরে সবাই কত খুশি। মা বাবা কত গর্বিত।
নন্তুর মনে আনন্দ আছে নতুন শহরে নতুন চাকরিতে যোগ দেওয়ার। দুঃখও আছে বাড়ির সবাইকে ছেড়ে যাওয়ার। আশঙ্কা আছে অচেনা শহর নিয়ে। আক্ষেপ আছে শ্রীময়ির জন্য। আক্ষেপ আছে এই কলকাতা শহরটা ছেড়ে যাওয়ার জন্য। ট্রেন ধরার দুদিন আগে নন্তু বেরিয়ে পড়েছিল একা একাই। শিয়ালদহ থেকে বাস না নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক্সাইড মোড় চলে গেছিল। এক্সাইড মোড়ে দাঁড়িয়ে একবার মনে হয়েছিল ফ্লাইং কালার্সে গিয়ে বম্বে যাওয়ার খবরটা দেবে, কিন্তু যায়নি। বরং একবার রতন দার দোকানে গেছিল। নন্তু বম্বে চলে যাচ্ছে শুনে রতন দার কী খুশি। স্পেশাল চা, ডিম টোস্ট, সিগারেট খাইয়েছে নন্তুকে। নন্তু পয়সা দিতে গেলে বলেছিল, “নন্তুদা, তোমার বম্বে যাওয়ার খুশিতে এটা আমার ট্রিট”। ট্রিট শুনে নন্তু খুব হেসেছিল। জড়িয়ে ধরেছিল রতন দাকে। রতন দা নিজের ফোন নম্বরটা দিয়ে বলেছিল, “যোগাযোগ রেখো”।
সমস্ত প্যাকিং করতে করতে শেষ দুদিনও কেটে গেল। জামাকাপড়, বিছানার চাদর, নিজের জিনিষপত্রের থেকে বেশি হয়ে গেল মায়ের ভালোবাসা। মা একগাদা খাবার জিনিষ দিয়েছে যেগুলো নিতেই হবে। কী নেই তার মধ্যে? তিলের নাড়ু, ছোলার ছাতু, নারকেল নাড়ু, মুড়ির মোয়া, চানাচুর, ডালমুট, বিস্কুট আরও কতকিছু। প্রথমে রে রে করে উঠলেও পরে সব গুছিয়ে নিতে হল। ল্যাপটপের ব্যাগপ্যাক আর একটা ট্রলি নিয়ে যাবে ভেবেছিল নন্তু। সঙ্গে আরও দুটো ব্যাগ বেড়ে গেল। ব্যাগ বাড়লেও মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নন্তু কিছু বলেনি। যাওয়ার আগে মা রোজই কেঁদেছেন। খবরটা পাওয়ার পর থেকে খুশিই ছিলেন। বাবা যেদিন টিকিটটা কেটে আনলেন সেদিন থেকেই মায়ের কান্না শুরু হল। আরতী দেবী একবার করে বলেন “আমি খুব খুশি তুই এত ভালো চাকরি পেয়েছিস, কাঁদব না একদম”। আর বলার পরেই কেঁদে ফেলেন। নন্তুর হাজার সান্ত্বনাতেও লাভ হয়নি কোনও।
সকাল ৮টায় হাওড়া থেকে ট্রেন। হাওড়া-মুম্বই দুরন্ত এক্সপ্রেস। বাবা এসেছে নন্তুকে ছাড়তে। সিটের তলায় ব্যাগ গুলো রেখে, নন্তু বাবার সাথে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ি থেকে বেরোনোর পর ট্রেনে আসার পথে, বা ট্যাক্সিতে বাবা সেভাবে কথা বলেনি। খুব চুপচাপ। নন্তু খেয়াল করেছে সেটা। নন্তু ঘড়ি দেখল, আর মিনিট পাঁচেক বাকি ট্রেন ছাড়তে। বাবাকে বলল,
“তোমার মনে আছে তো, কথা দিয়েছ আমায় যে দুপুরের পর আর দোকান খুলবে না?”
বাবা ম্লান হাসি হাসলেন, “মনে আছে”
“আর কিছু বলবে তুমি?”
“কি বলি বল তো? আনন্দও হছে, তুই চলে যাচ্ছিস বলে দুঃখও হচ্ছে বড্ড”
“চেষ্টা তো করলাম এখানে থেকে তোমাদের সাথে থেকে কাজ করার, সেভাবে কিছুই তো হল না এই সাত বছরে”
“জানি রে, তাই তো আনন্দ হচ্ছে তোর জন্য যে এতদিনে তোর একটা ভালো কাজের সুযোগ এল” একটু থামলেন মহেশ বাবু।
ছেলের মাথায় হাত দিয়ে বললেন। “সাবধানে থাকিস বাবাই, ফোন করিস আমাদের”
বাবাকে জড়িয়ে ধরল নন্তু, “নিশ্চয়ই ফোন করব। আর তুমিও খুব সাবধানে থেকো, মায়ের খেয়াল রেখো”
মহেশ বাবু ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আছেন আর চোখ দিয়ে জল ঝরছে।
ইঞ্জিন থেকে একটা লম্বা হর্ণ শোনা গেল, সিগন্যাল হয়ে গেছে, ট্রেন ছাড়বে এবার।
নন্তু বাবাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে ট্রেনের দরজায় উঠে দাঁড়াল। ট্রেন ছেড়ে দিল। বাবা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছেন, নন্তুও হাত নাড়ছে। হাত নাড়তে নাড়তেই চোখ ভিজে এল নন্তুর। জল গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। প্ল্যাটফর্মে ভিড় আছে, বাবাকে আর দেখা যাচ্ছে না। আস্তে আস্তে প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে গেল। দরজা দিয়ে মাথা বের করে পেছনে ফেলে আসা শহরটাকে দেখার চেষ্টা করল। পেছনের ফেলে আসা শহর দেখতে দেখতে দরজায় দাঁড়িয়ে কেঁদে ফেলল নন্তু, গত কদিন ধরে এই কান্নাটা বুকে চেপে বসেছিল, বাড়িতে বাবা মায়ের সামনে কাঁদতে পারেনি।
২১
ট্রেনের বার্থে শুয়ে এমনিতেই নন্তুর ভালো ঘুম হয়না, তার উপর সবাইকে ছেড়ে এত দূরে যাচ্ছে ভাবলেই বারবার মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। রাতে শুয়ে শুয়ে খালি বাবার মুখটা মনে পড়ছিল, ট্রেন ছাড়ার সময় কেমন উদাস চোখে তাকিয়েছিল বাবা। সিটের উপর উঠে বসল নন্তু। জানলার পর্দাটা সরিয়ে বাইরে দেখল। দেখে মনে হচ্ছে কোনও স্টেশন আসছে। ট্রেনের স্পিডও কমছে। নন্তু চপ্পলটা গলিয়ে দরজার দিকে গেল। করিডরের ছোট দরজাটা খুলে বেরতেই দেখল প্যান্ট্রির ইউনিফর্ম পরে দুজন বসে খৈনি ডলছে। ওরাই বলল নাগপুর ঢুকছে। নন্তু দরজা খুলে দাঁড়াল। ট্রেনটা প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে একটা লম্বা বাঁক নিয়ে। নন্তুর বগিটা সামনের দিকে। দরজা দিয়ে পেছনের গোটা ট্রেনটা দেখতে দেখতে নন্তু ভাবছিল, এই বগিগুলোতে যারা যাচ্ছে, তাদের সবার কত আলাদা আলাদা গল্প আছে। অনেকে হয়ত নন্তুর মতই কাজের জন্য নিজের বাড়ি ছেড়ে প্রবাসী হতে যাচ্ছে। এদের বাড়িতেও নিশ্চয়ই বাবা মায়েরা দুঃখ করছে। কেন ছেড়ে যেতে হয় নিজেদের ঘর, পরিবার? কেন নিজের শহরে কাজ করতে পারে না নন্তুর মত লাখো লাখো মানুষ?
ট্রেন থেমে গেছে। নন্তু নামল প্ল্যাটফর্মে। নন্তুকে নামতে দেখে প্যান্ট্রির একজন বলে উঠল, “দাদা বেশীক্ষণ দাঁড়াবে না কিন্তু, এদিক ওদিক চলে যেও না যেন”
নন্তু ইশারায় বলল এখানেই আছি।
প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে নন্তু পুরো শেষ অবধি দেখছিল আর ভাবছিল। কত লোকে কত কিছু ছেড়ে আসে। ফেলে আসা মানুষগুলোকে কেউ ফিরে পায়, কেউ পায়না। কবে দেখা হবে আবার বাবা মা ভাইয়ের সাথে? ফিরলে কি শ্রীময়ি দেখা করবে আবার? সেই সবই তো ঠিক হল, কিন্তু একটু দেরী করে হল। ভালো কাজ পেয়েছে একটা। মাইনেটাও ভালো। এসব কটাদিন আগে হলে শ্রীময়ির সাথে ছাড়াছাড়িটা হতনা। ব্যাপারটা হয়ত অন্যরকম হত।
“ব্যাপারগুলো কি অন্যরকম হতে পারত না?” জিজ্ঞেস করল নন্তু।
নৌকো থেকে নামার পর শ্রীময়ি আর নন্তু ঠিক করল, প্রিন্সেপঘাট থেকে ইডেন অবধি হাঁটবে। হাঁটতে হাঁটতে কথাটা জিজ্ঞেস করল নন্তু।
শ্রীময়ি বলল, “কোন ব্যাপারগুলো?”
“এই আমি তুমি আমরা”
“নৌকায় বসে তুমিই তো বললে যে সব আমি-তুমি নাকি আমরা হয়ে ওঠেনা!”
“কিন্তু অন্যরকম কি হতে পারতো না ঘটনাগুলো?”
“যা হচ্ছে ভালোই তো হচ্ছে, কত ভালো চাকরি পেয়েছ বল তো?”
“সে তো না হয় পেয়েছি, কিন্তু দেরী হয়ে গেল অনেক”
“তাতে কী হয়েছে? ভালো চাকরি পেয়েছ সেটাই সবচেয়ে বড় কথা”
“আর তুমি?”
“আচ্ছা তুমি কোন ট্রেনে টিকিট কেটেছ?”
“মানে?”
“ট্রেনে যাবে তো নাকি ফ্লাইটে?”
“আমি তো অন্য একটা প্রশ্ন করলাম নাকি?”
“ওখানের ওই বন্ধুটার সাথে কথা হয়েছে তো ঠিক করে?”
তিন বছরে নন্তু একটা জিনিষ শিখেছে, শ্রীময়ির কথা ঘোরানোর সামনে কোটলার পিচে কুম্বলের স্পিনও নস্যি।
“কথা ঘুরছে কেন এরকম?”
“যাওয়ার সময় রাত্রিবেলা কোনও ভুলভাল স্টেশনে নামবে না কিন্তু”
স্টেশনে নামার কথাটা মনে পড়তেই নিজের মনে হেসে উঠল নন্তু। ট্রেনের দরজায় উঠে দাঁড়ালো। নন্তুর খুব শ্রীময়ির সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করল। নেটওয়ার্ক থাকছেনা বলে ফোনটা অফ করে রেখেছিল নন্তু। পকেট থেকে বের করে অন করল। ভাবছে ফোন করাটা ঠিক হবে কি না? ওদিকে সিগন্যাল হয়ে গেছে। হর্ণ দিয়ে ট্রেনটা ছেড়ে দিল। নন্তু ফোন করল শ্রীময়িকে। দুবার রিং হতেই ধরল শ্রীময়ি,
“জানতাম তুমি ফোন করবে আজ”
“বাহ কী কনফিডেন্স? তাই জেগে ছিলে?”
“কনফিডেন্সটা তো একদিনে আসেনি তাই না? আর এখন সবে সাড়ে বারোটা, এত তাড়াতাড়ি আমি কবে ঘুমিয়েছি শুনি? তোমার কথাই ভাবছিলাম আমি”
নন্তু একটু অবাক হল। ঠিক শুনছে তো! শ্রীময়ির গলায় একটা পুরনো সুর। এই সুরটা নন্তুর খুব চেনা। খুব ভালোবাসার। কিন্তু এই ভালোবাসার সুরে তো কথা বলার কথা নয়।
“তুমি সত্যিই আমার কথা ভাবছিলে?”
“বিশ্বাস হচ্ছে না?”
“না মানে –”
“মানে আমি তোমার কথাই ভাবছিলাম, বিশ্বাস হচ্ছে না?”
“মানে এত রাতে আমার কথা ভাবাটা কি ঠিক?”
“আমাকে এত রাতে ফোন করাটা কি ঠিক?”
নন্তু চুপ।
শ্রীময়ি বলল, “আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি নন্তু”
ট্রেনটা ভালো স্পিড নিয়েছে।
কথাটা শুনে নন্তুর মনে হল নন্তু এবার হয়ত দরজা দিয়ে পড়েই যাবে। সরে এল দরজা থেকে।
নন্তুর চোখের পাতা ভেজা। গলাটাও ধরে এসেছে,
“আমিও তো তোমাকে ভালোবাসি, শুধু সময়টা ভুল ছিল”
“কে বলেছে ভুল ছিল?”
“ভুল না তো কী? তোমার অন্য কোথাও বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, আমি অন্য শহরে চলে যাচ্ছি, এগুলো সব ঠিক বলতে চাও?”
“অন্য শহরে তো এত ভালো একটা কাজ নিয়ে যাচ্ছো, সেটা অবশ্যই ঠিক, একেবারেই ভুল নয়”
“মানলাম, কিন্তু অন্যটা?”
“সেটাও ঠিক হয়ে যাবে”
“কি ঠিক হয়ে যাবে?”
“সময় হলেই ঠিক হয়ে যাবে?” শ্রীময়ির গলায় হালকা হেঁয়ালির সুর
“হেঁয়ালি না করে একটু খুলে বলবে? আমার নেটওয়ার্ক চলে যাবে আবার”
“আমি বিয়েটা করছি না নন্তু”
নন্তুর সত্যিই এবার নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না।
“তুমি কি ইয়ার্কিই করে যাবে? তাহলে রাখছি আমি”
“আরে না না সত্যি, আমি সত্যিই বিয়েটা করছি না”
“মানে কী? কেন?”
“আচ্ছা ইডিয়ট তো তুমি! কেন? কেন জানোনা তুমি?”
“না মানে –”
“মানে তোমার মতো একটা ইডিয়টকে জ্বালাব সারা জীবন তাই”
নন্তু বুঝতে পারছে না স্বপ্ন দেখছে নাকি এসব সত্যিই হচ্ছে।
“কবে ঘটালে এই কান্ডটা?”
“সেটা জেনে কি হবে, তোমাকে বলার মতো একটা সুযোগ খুঁজছিলাম। সেদিন প্রিন্সেপঘাটেই বলতে ইচ্ছে করছিল খুব তাও বলিনি, কিন্তু আজ তোমাকে সারাদিন খুব মিস করেছি। ফোনেও পাচ্ছিলাম না। তুমি ফোন করলে আর আমি বলে ফেললাম – ”
শ্রীময়ি আরও কিছু বলল, কল ড্রপ করছে বলে শোনা গেল না। নন্তু দুবার হ্যালো হ্যালো করে দেখল নেটওয়ার্ক চলে গেছে।
নন্তু ফোনটা পকেটে রেখে আবার দরজাটা খুলল। ট্রেন ছুটছে। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু একটু তাকিয়ে থাকলে বেশ কয়েকটা আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে। দূরে কোথায় একটা গ্রাম আছে হয়তো। নন্তুর জীবনেও আলোর বিন্দু হয়ে আরেকবার ফিরে এসেছে শ্রীময়ি। কলকাতা ছেড়ে আসার জ্বালাটা যেন আরও একটু বেড়ে গেল নন্তুর।
চলবে…
ফেসবুকে ইনসাইড ভিসনের পেজ লাইক করতে টাচ করুন এখানে
Porbo ta hridoy chhue galo…
Darun.. Nesha dhore gache…
Kya baat…guru….chaliye jao….thik thak I egochho….mon ko chu gaya Aaj…. especially Aaj daughter’s day….so…. Sreemoyee r parents r sathey interaction was very touchy…valo laglo….porbo 7 r jonnyo wait korey thaklam…